মুক্তিযোদ্ধা নিধনযজ্ঞের দলিল রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:হাই কোর্ট ঘোষিত ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ একজন সেনাপতি শুধু খুনের মাধ্যমে ক্ষমতাই দখল করেননি, পরবর্তীতেও বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে জাপানের কিছু বিদ্রোহী একটি জাপানি বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করিয়েছিল, যে ঘটনায় বাংলাদেশের কোনো সেনারই সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে সুযোগটি  গ্রহণ করে বেশ কয়েক শ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও বৈমানিককে বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে মূলত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।  ত্বরিতগতিতে ফাঁসি দেওয়ার পর বেশির ভাগ লাশ গুম এবং এ সংক্রান্ত সব নথি ধ্বংস করায় ঠিক কতজনকে জিয়ার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল, তা কখনো জানা যায়নি। ফাঁসিতে ঝোলানো ব্যক্তিদের পোষ্যদের এবং সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ১৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। নিষ্ঠুরতার সঠিক চিত্র উদঘাটনের জন্য ঢাকা-বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের বর্তমান নিউজ এডিটর জায়েদুল আহসান (পিন্টু) এক মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফাঁসিতে ঝোলানো বহু ব্যক্তির স্বজনদের ছাড়াও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বহু সংশ্লিষ্টজনের। দুই দশকব্যাপী প্রচুর সাধনা এবং গবেষণার মাধ্যমে এমন সব বিরল দলিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন, যার দ্বারা সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গেজেট, ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস’ নামের একটি পুস্তক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং বিলেতের সানডে টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদন, তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালের কিছু নথি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড মাস্টার্স কর্তৃক তার দেশে পাঠানো কয়েকটি গোপন তারবার্তার কপি, ‘দৈনিক বাংলা’ এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাক’সহ বাংলাদেশে প্রকাশিত কিছু সংবাদপত্র, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ইস্যুকৃত কিছু গোপন দলিল, সে সময়ের জাপানি এক মন্ত্রীর ১৯৭৮ সালে লেখা জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ জি মাহমুদ লিখিত ‘মাই ডেসটিনি’, লে. কর্নেল এম এ হামিদের বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’, কারাগার থেকে জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছে জেনারেল এরশাদের লেখা গোপন চিঠি, ১৯৭৭ সালের ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত ‘দি মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল রেগুলেশন ১৯৭৭’, ১৮ অক্টোবর প্রচারিত আইএসপিআরের ভাষ্য, ব্যারিস্টার মওদুদের বই ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দি চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের পুস্তক ‘দি লিগেসি অব ব্লাড’। তিনি সে সময়ে জাপানি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রচুর ছবি সংগ্রহ করেছেন।

 

১৯৭৭ সালে জিয়ার নির্দেশে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে অনুসন্ধানী ছিলেন বিধায় পিন্টু সাহেব ১৯৯৭ সালেই ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় এ ব্যাপারে ধারাবাহিক লেখা শুরু করলে তার সঙ্গে কথা বলেন ফাঁসিতে ঝোলানো অনেকের স্বজন। পরবর্তীতে তিনি ‘রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি’ নামে বইটি ২০০৮ এবং ২০১৫ সালে প্রকাশ করলে সেটি গরম পিঠার মতো বিক্রি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঘটনাবলির আরও বিস্তারিত তথ্য এবং ছবি দিয়ে বর্ধিত কলেবরে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ‘রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার’ নামে বইটি প্রকাশ করেন। বইটিতে ফাঁসিতে ঝোলানো বহু ব্যক্তির ছবি ছেপেছেন তাদের আপনজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন, সত্য উদঘাটনের স্বার্থে দীর্ঘ অনুসন্ধানকালে শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিলেন সে সময়ের বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) এ জি মাহমুদ, লে. জেনারেল মীর শওকত আলি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফি মেহবুব, লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাপানি পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই, ট্রাইব্যুনালের বেশ কজন চেয়ারম্যান, তখনকার কারা বিভাগের আইজি লিয়াকত আলি খান, কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ এরশাদুর রহমান, বিশ্বনন্দিত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ, ফাঁসিতে ঝোলানো ৫০-এর বেশি শহীদের পোষ্যদের। তিনি লিখেছেন, ‘দেশের আনাচে-কানাচে যেখানেই সামান্য সূত্র বা তথ্যের আভাস পেয়েছি, সেখানেই ছুটে গিয়েছি।’

 

ছাপানো হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানের তখনকার গোরখোদক দ্বীন ইসলামের ছবি, যিনি লেখককে বলেছিলেন তাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল ‘কেউ যেন এ খবর জানতে না পারে’। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, ‘এত লাশ কোথা থেকে আসে’। দ্বীন ইসলাম বলেছেন, ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি, আর আজিমপুরে দাফন চলতে থাকে। রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১২১ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। দিন দিন সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২৯ অক্টোবর থেকে ১৯৭৮-এর ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের কুমিল্লা কারাগারে পাঠিয়ে সেখানে ৭২ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবৈধভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যে জিয়াউর রহমান নাটকটি সাজিয়েছিলেন, বিচারের প্রহসন মঞ্চস্থ করে, পিন্টু সাহেবের কাছে সে কথা জিয়ার অনুগত অনেকেই স্বীকার করেছেন। লে. জেনারেল মীর শওকত আলিকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ২২ অক্টোবরের ঘটনাটি আসলেই কোনো অভ্যুত্থান ছিল কি না, কেননা অনেক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন সেদিন আসলে জেনারেল জিয়া পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র বাহিনীতে তার শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন। জবাবে জেনারেল শওকত ফাঁদ পাতার বিষয়ে মন্তব্য না করলেও এটুকু স্বীকার করেছেন যে, তার কাছেও বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়েছে। জেনারেল শওকত বলেছিলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বিচারের মাধ্যমে ১ হাজার ১৩০ জনের মৃত্যুর খবর তিনি শুনেছেন।’ জেনারেল শওকত আলির এডিসি, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার শফি মেহবুব পিন্টু সাহেবকে বলেছেন, ’৭৭ সালে জেনারেল শওকত বেশ ক্ষিপ্র থাকলেও ‘নির্বিচারে ফাঁসির সময় তাকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়, অনেকটাই নীরবে বাঁশি বাজানোর মতো।’ জেনারেল এরশাদও সামরিক আদালতগুলোকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন। কারাগার থেকে জাতীয় পার্টি নেতাদের কাছে লেখা গোপন চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘৫০০ জন সিপাহিকে জিয়া ফাঁসি দিয়েছে।… আমার CAS হওয়ার আগেই জিয়া ফাঁসি কার্যকর করে… এক একটা ফাঁসির বিচার হয়েছে ৫ মিনিটে। জনগণ জানুক।’ লেখক সেই গোপন চিঠির কপি তার বইতে ছেপেছেন।

 

বেআইনিভাবে গঠিত এক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জহিরুল হক খান পিন্টু সাহেবকে বলেছেন, ‘তাড়াহুড়ো করে গঠন করা এসব সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলেও সদস্যদের কিছুই করার ছিল না, যেভাবে নির্দেশ আসত, সেভাবেই রায় ঘোষণা করতে হতো।’ আরও বলেছেন, ‘যে অন্যায় ও অবিচারের রায় দিয়েছি, তার জন্য এখনো দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করে চলছি।’ আরেক ট্রাইব্যুনালের প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা পুস্তকটির লেখককে বলেছেন, ‘নির্বিচার ফাঁসির রায় দেওয়ার স্মৃতি আমাকে আজও দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। কার্যত রায়ের আদেশগুলো আসত জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল রেগুলেশন সংশোধন করে তিনি এই কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়েছিলেন। এমনকি সেনা সদর দফতর থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।’ বিমান বাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষিত মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালগুলোতে তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের প্রধানরা বিচার প্রহসনের সময় এক একজন সৈনিকের জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিলেন।

 

এমনকি বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এ জি মাহমুদও সাক্ষাৎকারকালে ন্যায়বিচার না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। জিয়ার কোর্সমেট লে. কর্নেল এম এ হামিদও এই বিচারকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন।

 

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় লেখা হয়, ১৯৭৮-এর ১৯ জানুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাঠানো গোপনীয় তারবার্তায় আমেরিকান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আলফ্রেড বার্গেসেন বলেছিলেন, ‘আমাদের মনে হয় মিলিটারি কোর্ট স্থাপনের আগেই সম্ভবত ৩০-৪০ জনকে হত্যা করা হয়।’ এর পরপরই লন্ডনস্থ সানডে টাইমস পত্রিকায় লেখা হয় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের এই বক্তব্য ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের রিপোর্টকেই সমর্থন করে। তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনুগত সৈনিকরা কোর্ট মার্শালে বিচারে নেওয়ার আগেই অনেককে হত্যা করেছে। ওই পত্রিকায় ১৯৭৮-এর ৫ মার্চের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনের বরাত দিয়ে জানা যায়, ওই ঘটনায় আট শতাধিক সামরিক ব্যক্তির সাজা হয় এবং ৬০০ জনকে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। বইটিতে নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের কপি ছাপা হয়েছে। লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘সরকার যে রাতে আইএসপিআরের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বক্তব্য প্রচার করে সে রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়। এও লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার দায়ে বিমান ও সেনাবাহিনীর শত শত সৈনিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের অনেককে গণফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। গোপন বিচারে একরকম একতরফাভাবেই ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।

 

ছাপানো তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর সরকার বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করলেও জিয়া কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। পিন্টু সাহেব লিখেছেন, ‘প্রহসনের দিকটি হলো, ঘটনা অনুসন্ধানে কমিশন গঠনের আগেই তথাকথিত বিচারের নামে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কতজনকে এভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তা কখনো জানানো হয়নি।’ জিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যারিস্টার মওদুদ, জেনারেল এরশাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণজন বলেছেন, এ সংক্রান্ত সব নথি ধ্বংস করা হয়েছে।

 

লেখক পিন্টু সাহেব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সে সময়ের ডেপুটি সুপার লিয়াকত আলি খানের ভাষ্য পুনঃমুদ্রণ করে লিখেছেন, ‘মৃত্যুদন্ড কার্যকর জল্লাদই করেন, ডিআইজি প্রিজনকে শুধু সশরীরে উপস্থিত থেকে ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত সংকেত দিতে হয়। কিন্তু ডেপুটি সুপার লিয়াকত আলিকেই দায়িত্বটি নিতে হয়েছিল, কেননা তখনকার ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন্স ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম রাতে যা দেখেছিলেন তাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ রকম নির্বিচারে মানুষকে টেনেহিঁচড়ে ধরে এনে ফাঁসি দেওয়ার দৃশ্য দেখে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছিল না।’ ‘জেলখানায় তখন এক-দুজন নয়, ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল পাইকারি হারে আট-দশজন করে প্রতি রাতে। যাদের এভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা।’ পিন্টু সাহেব উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয় এভাবে গণহারে ফাঁসি দেওয়া। চলতে থাকে প্রায় দুই মাস। কতজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? জানার উপায় নেই। নানা উৎস থেকে ধারণা করা হয়, সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৪০০-এর মধ্যে। প্রায় বিনা বিচারে এ বিপুলসংখ্যক লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে কাউকে টর্চার সেলে। সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল কতগুলো, সেটা জানা যায় না। সেখানে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। কেননা ট্রাইব্যুনালের বিচারক নয়, শেষ আদেশটি আসত সেনাশাসকের কলম থেকে। সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এখনো আমি ফাঁসিতে নিহতদের ছেলেমেয়েদের মুখোমুখি হই- যারা রিপোর্ট বা আমার বইটি পড়েননি। তারা নিজেদের নিখোঁজ পিতার সন্ধানে আমার কাছে আসেন।’ লিখেছেন ‘ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং কার্যক্রম দেখলেই বোঝা যায়, আয়োজনটি ছিল দায়সারা। বিচারের নামে সৈনিকদের ওপর প্রতিশোধ চরিতার্থ করাই ছিল উদ্দেশ্য।’ তার যুক্তি, ‘যদি আইএসপিআরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তির বরাতে সরকারি হিসাবও ধরে নিই, তাতে দেখা যায়, ৭ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিনে ৪৬০ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪৬ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হওয়া মৃত্যুদন্ডের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই একই সময়ে ১১৩ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এভাবে ১১ কার্যদিবসে ১৯৩ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।’ তিনি লিখেছেন, ‘ট্রাইব্যুনালগুলোতে কীভাবে বিচার কার্যক্রম চলেছে সেটা বুঝতে আমি এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা সরাসরি বিচারকের আসনে বসেছিলেন। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা ছিল এসব বিচার প্রক্রিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ ফাঁসিতে ঝোলানো সার্জেন্ট তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী বলেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি একটি চিঠি পান বিমান বাহিনীর রেকর্ড অফিস থেকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘তোফাজ্জল হোসেন অক্টোবরের ১ ও ২ তারিখের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে তার সাজা হয়েছে। সাজার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী খবর যথাসময়ে জানানো হবে।’ তোফাজ্জলের খবর জানিয়ে আর কোনো চিঠি আসেনি তার স্ত্রীর কাছে। নথি বলছে, ওই চিঠি পাঠানোর অনেক আগেই ১০ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তোফাজ্জলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পিন্টু সাহেবের গবেষণাভিত্তিক লেখা থেকে জানা যায়, ‘অভিযুক্তদের অনেকেই জানতেনও না, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী, যাদের ফাঁসির আদেশ হতো, রায় জানানোর রাতেই কিংবা পরের রাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর হতো। অনেক পরিবারকে জানানোই হয়নি, অনেককে জানানো হয়েছে ফাঁসি দেওয়ার দুই মাস পরে।’ ’৭৭-এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কারাগারগুলোতে যখন সন্ধ্যা নেমে আসত তখন প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসত গগনবিদারী কান্নার রোল। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ এতই তড়িঘড়ি বন্দিদের ফাঁসি দিচ্ছিল যে, একই নামের একজনকে ফেলে অন্যজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। পশুপাখির মতো জোর করে টেনেহিঁচড়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গলায় রশি ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।’ বইটির লেখা থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্তাদের প্রাধান্য দিতেন। আরও জানা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনকে লিখেছিলেন, নভেম্বরে বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দি ছিল এবং রাষ্ট্রদূত তাদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করলে জিয়া কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে অন্তরিন থাকা ব্যক্তির সংখ্যা কয়েক শ উল্লেখ করেছিলেন। পিন্টু সাহেব লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া ছোট্ট বিমান বাহিনীকেই একসময় বিলুপ্ত করার কথা চিন্তাভাবনা শুরু করেন জিয়াউর রহমান। লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলি জানিয়েছিলেন, জেনারেল জিয়া বিমান বাহিনী বিলুপ্ত করে এর জনবল ও সম্পদ আর্মি এভিয়েশন কোরের অধীনে নিয়ে আসার চিন্তা করেছিলেন। প্রায় দুই মাস তাই বিমান বাহিনীর কোনো কার্যক্রম ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত জিয়া তার চিন্তা থেকে সরে এসেছিলেন। শত শত বিমান সেনাকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জি মাহমুদ স্বীকার করেন, বিচার প্রক্রিয়ায় তাকে সম্পৃক্ত না করায় বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে তিনি কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে যান; জিয়ার আস্থা হারিয়ে মাস দুই পর তাকে বাহিনী থেকে চলে যেতে হয়।

 

লেখক ভুক্তভোগী পরিবারের বহুজনের সাক্ষাৎ নিয়েছেন, যাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমানের পুত্র, কামরুজ্জামান লেলিন, যিনি লিখেছেন, বাবা যে অফিসে গেলেন আর ফিরে এলেন না। ৭-৮ দিন পর জেলখানা থেকে বাবা একটা চিঠি পাঠালেন সিগারেটের খামে লোক মারফত। বাবার হাতের লেখা মায়ের কাছে দেওয়া চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমি এ ঘটনার কিছুই জানি না, তারপরও ওরা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে।’ সাম্প্রতিককালে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের কান্না’ নামে যে আন্দোলন শুরু করেছেন, লেলিন তাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের দাবি, জিয়ার মরণোত্তর বিচার হোক, জিয়ার ভুয়া কবর সংসদ এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হোক, জানতে চান তাদের স্বামী-পিতাদের কোথায় বা আদৌ দাফন করা হয়েছে কি না, কবে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? ফাঁসিতে ঝোলানো ব্যক্তিদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের বিশ্বময় বিধান থাকলেও জিয়া তা করেননি। ১৯৭৭-এর হত্যাযজ্ঞের পর বহু বছর পার হয়ে গেলেও দিনের পর দিন এগুলো গোপন রাখা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে নথিপত্র। গোপনীয়তার জাল ছিন্ন হয় ১৯৯৬ সালে। জায়েদুল আহসান পিন্টু সাহেব ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। লেখক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং বগুড়া কারাগার থেকে ফাঁসিতে ঝোলানো বেশ কিছু সৈনিকের নাম এবং ফাঁসি দেওয়ার তারিখ সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করেছেন।

 

বইটিতে এমন সব তথ্য এবং দলিল ছাপা হয়েছে, যা আগে জানা ছিল না, অথচ যা জানা জাতির জন্য অপরিহার্য। জিয়াউর রহমানের নৃশংসতা নিয়ে ভবিষ্যতে যারা গবেষণা করবেন, বিরল তথ্য-প্রমাণাদিপূর্ণ এই বইটি হবে তাদের জন্য অমূল্য উৎস। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করলে, সেই কমিশনের জন্যও বইটি হবে অকাট্য সম্পদ।  বইয়ের লেখক দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব তথ্য, চিত্র এবং দলিল সংগ্রহ করেছেন,  তা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডাকাত দলের মারধরে বাড়ির মালিকের মৃত্যু

» এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল দেখা যাবে যেভাবে

» সিলেটে চলছে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট

» বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

» সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ‘চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত বেআইনি, আমরা এখনো স্বপদে বহাল আছি’

» বিগত তিন নির্বাচনকে ‘বৈধ’ বলা পর্যবেক্ষকদের সুযোগ দেওয়া হবে না : সিইসি

» এসিড নিক্ষেপ ও মারধরের অভিযোগে ডিপজলের বিরুদ্ধে মামলা

» মবই সরকারের শক্তি, জুলাই আন্দোলনের বিজয়ী শক্তি একটা ভয়ের রাজত্ব তৈরি করছে : শামীম হায়দার

» যে রিকশাচালকের সাথে একই জেলে ছিলেন আখতার; স্মৃতি হাতড়ে কাঁদলেন দুজনেই

» ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ: ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চালাচ্ছে ঢাকা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মুক্তিযোদ্ধা নিধনযজ্ঞের দলিল রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:হাই কোর্ট ঘোষিত ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ একজন সেনাপতি শুধু খুনের মাধ্যমে ক্ষমতাই দখল করেননি, পরবর্তীতেও বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে জাপানের কিছু বিদ্রোহী একটি জাপানি বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করিয়েছিল, যে ঘটনায় বাংলাদেশের কোনো সেনারই সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে সুযোগটি  গ্রহণ করে বেশ কয়েক শ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও বৈমানিককে বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে মূলত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।  ত্বরিতগতিতে ফাঁসি দেওয়ার পর বেশির ভাগ লাশ গুম এবং এ সংক্রান্ত সব নথি ধ্বংস করায় ঠিক কতজনকে জিয়ার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল, তা কখনো জানা যায়নি। ফাঁসিতে ঝোলানো ব্যক্তিদের পোষ্যদের এবং সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ১৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। নিষ্ঠুরতার সঠিক চিত্র উদঘাটনের জন্য ঢাকা-বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের বর্তমান নিউজ এডিটর জায়েদুল আহসান (পিন্টু) এক মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফাঁসিতে ঝোলানো বহু ব্যক্তির স্বজনদের ছাড়াও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বহু সংশ্লিষ্টজনের। দুই দশকব্যাপী প্রচুর সাধনা এবং গবেষণার মাধ্যমে এমন সব বিরল দলিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন, যার দ্বারা সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গেজেট, ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস’ নামের একটি পুস্তক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং বিলেতের সানডে টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদন, তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালের কিছু নথি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড মাস্টার্স কর্তৃক তার দেশে পাঠানো কয়েকটি গোপন তারবার্তার কপি, ‘দৈনিক বাংলা’ এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাক’সহ বাংলাদেশে প্রকাশিত কিছু সংবাদপত্র, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ইস্যুকৃত কিছু গোপন দলিল, সে সময়ের জাপানি এক মন্ত্রীর ১৯৭৮ সালে লেখা জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ জি মাহমুদ লিখিত ‘মাই ডেসটিনি’, লে. কর্নেল এম এ হামিদের বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’, কারাগার থেকে জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছে জেনারেল এরশাদের লেখা গোপন চিঠি, ১৯৭৭ সালের ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত ‘দি মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল রেগুলেশন ১৯৭৭’, ১৮ অক্টোবর প্রচারিত আইএসপিআরের ভাষ্য, ব্যারিস্টার মওদুদের বই ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দি চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের পুস্তক ‘দি লিগেসি অব ব্লাড’। তিনি সে সময়ে জাপানি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রচুর ছবি সংগ্রহ করেছেন।

 

১৯৭৭ সালে জিয়ার নির্দেশে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে অনুসন্ধানী ছিলেন বিধায় পিন্টু সাহেব ১৯৯৭ সালেই ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় এ ব্যাপারে ধারাবাহিক লেখা শুরু করলে তার সঙ্গে কথা বলেন ফাঁসিতে ঝোলানো অনেকের স্বজন। পরবর্তীতে তিনি ‘রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি’ নামে বইটি ২০০৮ এবং ২০১৫ সালে প্রকাশ করলে সেটি গরম পিঠার মতো বিক্রি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঘটনাবলির আরও বিস্তারিত তথ্য এবং ছবি দিয়ে বর্ধিত কলেবরে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ‘রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার’ নামে বইটি প্রকাশ করেন। বইটিতে ফাঁসিতে ঝোলানো বহু ব্যক্তির ছবি ছেপেছেন তাদের আপনজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন, সত্য উদঘাটনের স্বার্থে দীর্ঘ অনুসন্ধানকালে শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিলেন সে সময়ের বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) এ জি মাহমুদ, লে. জেনারেল মীর শওকত আলি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফি মেহবুব, লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাপানি পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই, ট্রাইব্যুনালের বেশ কজন চেয়ারম্যান, তখনকার কারা বিভাগের আইজি লিয়াকত আলি খান, কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ এরশাদুর রহমান, বিশ্বনন্দিত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ, ফাঁসিতে ঝোলানো ৫০-এর বেশি শহীদের পোষ্যদের। তিনি লিখেছেন, ‘দেশের আনাচে-কানাচে যেখানেই সামান্য সূত্র বা তথ্যের আভাস পেয়েছি, সেখানেই ছুটে গিয়েছি।’

 

ছাপানো হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানের তখনকার গোরখোদক দ্বীন ইসলামের ছবি, যিনি লেখককে বলেছিলেন তাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল ‘কেউ যেন এ খবর জানতে না পারে’। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, ‘এত লাশ কোথা থেকে আসে’। দ্বীন ইসলাম বলেছেন, ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি, আর আজিমপুরে দাফন চলতে থাকে। রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১২১ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। দিন দিন সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২৯ অক্টোবর থেকে ১৯৭৮-এর ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের কুমিল্লা কারাগারে পাঠিয়ে সেখানে ৭২ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবৈধভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যে জিয়াউর রহমান নাটকটি সাজিয়েছিলেন, বিচারের প্রহসন মঞ্চস্থ করে, পিন্টু সাহেবের কাছে সে কথা জিয়ার অনুগত অনেকেই স্বীকার করেছেন। লে. জেনারেল মীর শওকত আলিকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ২২ অক্টোবরের ঘটনাটি আসলেই কোনো অভ্যুত্থান ছিল কি না, কেননা অনেক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন সেদিন আসলে জেনারেল জিয়া পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র বাহিনীতে তার শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন। জবাবে জেনারেল শওকত ফাঁদ পাতার বিষয়ে মন্তব্য না করলেও এটুকু স্বীকার করেছেন যে, তার কাছেও বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়েছে। জেনারেল শওকত বলেছিলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বিচারের মাধ্যমে ১ হাজার ১৩০ জনের মৃত্যুর খবর তিনি শুনেছেন।’ জেনারেল শওকত আলির এডিসি, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার শফি মেহবুব পিন্টু সাহেবকে বলেছেন, ’৭৭ সালে জেনারেল শওকত বেশ ক্ষিপ্র থাকলেও ‘নির্বিচারে ফাঁসির সময় তাকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়, অনেকটাই নীরবে বাঁশি বাজানোর মতো।’ জেনারেল এরশাদও সামরিক আদালতগুলোকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন। কারাগার থেকে জাতীয় পার্টি নেতাদের কাছে লেখা গোপন চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘৫০০ জন সিপাহিকে জিয়া ফাঁসি দিয়েছে।… আমার CAS হওয়ার আগেই জিয়া ফাঁসি কার্যকর করে… এক একটা ফাঁসির বিচার হয়েছে ৫ মিনিটে। জনগণ জানুক।’ লেখক সেই গোপন চিঠির কপি তার বইতে ছেপেছেন।

 

বেআইনিভাবে গঠিত এক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জহিরুল হক খান পিন্টু সাহেবকে বলেছেন, ‘তাড়াহুড়ো করে গঠন করা এসব সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলেও সদস্যদের কিছুই করার ছিল না, যেভাবে নির্দেশ আসত, সেভাবেই রায় ঘোষণা করতে হতো।’ আরও বলেছেন, ‘যে অন্যায় ও অবিচারের রায় দিয়েছি, তার জন্য এখনো দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করে চলছি।’ আরেক ট্রাইব্যুনালের প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা পুস্তকটির লেখককে বলেছেন, ‘নির্বিচার ফাঁসির রায় দেওয়ার স্মৃতি আমাকে আজও দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। কার্যত রায়ের আদেশগুলো আসত জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল রেগুলেশন সংশোধন করে তিনি এই কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়েছিলেন। এমনকি সেনা সদর দফতর থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।’ বিমান বাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষিত মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালগুলোতে তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের প্রধানরা বিচার প্রহসনের সময় এক একজন সৈনিকের জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিলেন।

 

এমনকি বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এ জি মাহমুদও সাক্ষাৎকারকালে ন্যায়বিচার না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। জিয়ার কোর্সমেট লে. কর্নেল এম এ হামিদও এই বিচারকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন।

 

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় লেখা হয়, ১৯৭৮-এর ১৯ জানুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাঠানো গোপনীয় তারবার্তায় আমেরিকান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আলফ্রেড বার্গেসেন বলেছিলেন, ‘আমাদের মনে হয় মিলিটারি কোর্ট স্থাপনের আগেই সম্ভবত ৩০-৪০ জনকে হত্যা করা হয়।’ এর পরপরই লন্ডনস্থ সানডে টাইমস পত্রিকায় লেখা হয় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের এই বক্তব্য ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের রিপোর্টকেই সমর্থন করে। তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনুগত সৈনিকরা কোর্ট মার্শালে বিচারে নেওয়ার আগেই অনেককে হত্যা করেছে। ওই পত্রিকায় ১৯৭৮-এর ৫ মার্চের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনের বরাত দিয়ে জানা যায়, ওই ঘটনায় আট শতাধিক সামরিক ব্যক্তির সাজা হয় এবং ৬০০ জনকে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। বইটিতে নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের কপি ছাপা হয়েছে। লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘সরকার যে রাতে আইএসপিআরের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বক্তব্য প্রচার করে সে রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়। এও লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার দায়ে বিমান ও সেনাবাহিনীর শত শত সৈনিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের অনেককে গণফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। গোপন বিচারে একরকম একতরফাভাবেই ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।

 

ছাপানো তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর সরকার বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করলেও জিয়া কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। পিন্টু সাহেব লিখেছেন, ‘প্রহসনের দিকটি হলো, ঘটনা অনুসন্ধানে কমিশন গঠনের আগেই তথাকথিত বিচারের নামে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কতজনকে এভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তা কখনো জানানো হয়নি।’ জিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যারিস্টার মওদুদ, জেনারেল এরশাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণজন বলেছেন, এ সংক্রান্ত সব নথি ধ্বংস করা হয়েছে।

 

লেখক পিন্টু সাহেব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সে সময়ের ডেপুটি সুপার লিয়াকত আলি খানের ভাষ্য পুনঃমুদ্রণ করে লিখেছেন, ‘মৃত্যুদন্ড কার্যকর জল্লাদই করেন, ডিআইজি প্রিজনকে শুধু সশরীরে উপস্থিত থেকে ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত সংকেত দিতে হয়। কিন্তু ডেপুটি সুপার লিয়াকত আলিকেই দায়িত্বটি নিতে হয়েছিল, কেননা তখনকার ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন্স ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম রাতে যা দেখেছিলেন তাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ রকম নির্বিচারে মানুষকে টেনেহিঁচড়ে ধরে এনে ফাঁসি দেওয়ার দৃশ্য দেখে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছিল না।’ ‘জেলখানায় তখন এক-দুজন নয়, ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল পাইকারি হারে আট-দশজন করে প্রতি রাতে। যাদের এভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা।’ পিন্টু সাহেব উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয় এভাবে গণহারে ফাঁসি দেওয়া। চলতে থাকে প্রায় দুই মাস। কতজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? জানার উপায় নেই। নানা উৎস থেকে ধারণা করা হয়, সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৪০০-এর মধ্যে। প্রায় বিনা বিচারে এ বিপুলসংখ্যক লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে কাউকে টর্চার সেলে। সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল কতগুলো, সেটা জানা যায় না। সেখানে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। কেননা ট্রাইব্যুনালের বিচারক নয়, শেষ আদেশটি আসত সেনাশাসকের কলম থেকে। সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এখনো আমি ফাঁসিতে নিহতদের ছেলেমেয়েদের মুখোমুখি হই- যারা রিপোর্ট বা আমার বইটি পড়েননি। তারা নিজেদের নিখোঁজ পিতার সন্ধানে আমার কাছে আসেন।’ লিখেছেন ‘ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং কার্যক্রম দেখলেই বোঝা যায়, আয়োজনটি ছিল দায়সারা। বিচারের নামে সৈনিকদের ওপর প্রতিশোধ চরিতার্থ করাই ছিল উদ্দেশ্য।’ তার যুক্তি, ‘যদি আইএসপিআরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তির বরাতে সরকারি হিসাবও ধরে নিই, তাতে দেখা যায়, ৭ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিনে ৪৬০ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪৬ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হওয়া মৃত্যুদন্ডের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই একই সময়ে ১১৩ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এভাবে ১১ কার্যদিবসে ১৯৩ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।’ তিনি লিখেছেন, ‘ট্রাইব্যুনালগুলোতে কীভাবে বিচার কার্যক্রম চলেছে সেটা বুঝতে আমি এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা সরাসরি বিচারকের আসনে বসেছিলেন। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা ছিল এসব বিচার প্রক্রিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ ফাঁসিতে ঝোলানো সার্জেন্ট তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী বলেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি একটি চিঠি পান বিমান বাহিনীর রেকর্ড অফিস থেকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘তোফাজ্জল হোসেন অক্টোবরের ১ ও ২ তারিখের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে তার সাজা হয়েছে। সাজার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী খবর যথাসময়ে জানানো হবে।’ তোফাজ্জলের খবর জানিয়ে আর কোনো চিঠি আসেনি তার স্ত্রীর কাছে। নথি বলছে, ওই চিঠি পাঠানোর অনেক আগেই ১০ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তোফাজ্জলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পিন্টু সাহেবের গবেষণাভিত্তিক লেখা থেকে জানা যায়, ‘অভিযুক্তদের অনেকেই জানতেনও না, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী, যাদের ফাঁসির আদেশ হতো, রায় জানানোর রাতেই কিংবা পরের রাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর হতো। অনেক পরিবারকে জানানোই হয়নি, অনেককে জানানো হয়েছে ফাঁসি দেওয়ার দুই মাস পরে।’ ’৭৭-এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কারাগারগুলোতে যখন সন্ধ্যা নেমে আসত তখন প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসত গগনবিদারী কান্নার রোল। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ এতই তড়িঘড়ি বন্দিদের ফাঁসি দিচ্ছিল যে, একই নামের একজনকে ফেলে অন্যজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। পশুপাখির মতো জোর করে টেনেহিঁচড়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গলায় রশি ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।’ বইটির লেখা থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্তাদের প্রাধান্য দিতেন। আরও জানা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনকে লিখেছিলেন, নভেম্বরে বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দি ছিল এবং রাষ্ট্রদূত তাদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করলে জিয়া কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে অন্তরিন থাকা ব্যক্তির সংখ্যা কয়েক শ উল্লেখ করেছিলেন। পিন্টু সাহেব লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া ছোট্ট বিমান বাহিনীকেই একসময় বিলুপ্ত করার কথা চিন্তাভাবনা শুরু করেন জিয়াউর রহমান। লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলি জানিয়েছিলেন, জেনারেল জিয়া বিমান বাহিনী বিলুপ্ত করে এর জনবল ও সম্পদ আর্মি এভিয়েশন কোরের অধীনে নিয়ে আসার চিন্তা করেছিলেন। প্রায় দুই মাস তাই বিমান বাহিনীর কোনো কার্যক্রম ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত জিয়া তার চিন্তা থেকে সরে এসেছিলেন। শত শত বিমান সেনাকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জি মাহমুদ স্বীকার করেন, বিচার প্রক্রিয়ায় তাকে সম্পৃক্ত না করায় বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে তিনি কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে যান; জিয়ার আস্থা হারিয়ে মাস দুই পর তাকে বাহিনী থেকে চলে যেতে হয়।

 

লেখক ভুক্তভোগী পরিবারের বহুজনের সাক্ষাৎ নিয়েছেন, যাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমানের পুত্র, কামরুজ্জামান লেলিন, যিনি লিখেছেন, বাবা যে অফিসে গেলেন আর ফিরে এলেন না। ৭-৮ দিন পর জেলখানা থেকে বাবা একটা চিঠি পাঠালেন সিগারেটের খামে লোক মারফত। বাবার হাতের লেখা মায়ের কাছে দেওয়া চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমি এ ঘটনার কিছুই জানি না, তারপরও ওরা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে।’ সাম্প্রতিককালে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের কান্না’ নামে যে আন্দোলন শুরু করেছেন, লেলিন তাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের দাবি, জিয়ার মরণোত্তর বিচার হোক, জিয়ার ভুয়া কবর সংসদ এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হোক, জানতে চান তাদের স্বামী-পিতাদের কোথায় বা আদৌ দাফন করা হয়েছে কি না, কবে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? ফাঁসিতে ঝোলানো ব্যক্তিদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের বিশ্বময় বিধান থাকলেও জিয়া তা করেননি। ১৯৭৭-এর হত্যাযজ্ঞের পর বহু বছর পার হয়ে গেলেও দিনের পর দিন এগুলো গোপন রাখা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে নথিপত্র। গোপনীয়তার জাল ছিন্ন হয় ১৯৯৬ সালে। জায়েদুল আহসান পিন্টু সাহেব ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। লেখক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং বগুড়া কারাগার থেকে ফাঁসিতে ঝোলানো বেশ কিছু সৈনিকের নাম এবং ফাঁসি দেওয়ার তারিখ সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করেছেন।

 

বইটিতে এমন সব তথ্য এবং দলিল ছাপা হয়েছে, যা আগে জানা ছিল না, অথচ যা জানা জাতির জন্য অপরিহার্য। জিয়াউর রহমানের নৃশংসতা নিয়ে ভবিষ্যতে যারা গবেষণা করবেন, বিরল তথ্য-প্রমাণাদিপূর্ণ এই বইটি হবে তাদের জন্য অমূল্য উৎস। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করলে, সেই কমিশনের জন্যও বইটি হবে অকাট্য সম্পদ।  বইয়ের লেখক দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব তথ্য, চিত্র এবং দলিল সংগ্রহ করেছেন,  তা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com